সাধারণ বিচারে ধান উৎপাদনের জন্য হাওর একটা বৈরী পরিবেশ।

চৈতালি ঢল নিয়ে কিছু বলি। বিজ্ঞানীদের মতে, চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম) থেকে পরবর্তী তিন-চার দিন হাওরে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যদি ১৫০ মিলিমিটার (সংকট মাত্রা) ছাড়িয়ে যায়, তবেই ওই এলাকায় এ ধরনের ঢল হওয়ার সম্ভাবনা। চৈতালি ঢল অতীতে ছিল। তবে আজকের মতো এতটা ভয়ানক আকারে ছিল বলে কোনো রেকর্ড নেই। বঙ্গাব্দ ১৩৫৩ (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ১৪২৩ (২০১৭ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত মোট ছয়বার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ১৩৭০ বঙ্গাব্দে প্রথম সংকট মাত্রা অতিক্রম করে। সেবারে ওই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৫৬ মিলিমিটার। সংকট মাত্রা থেকে সামান্য বেশি। তার পরে ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে (১৮ বছর পর) সংঘটিত মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৯১ মিলিমিটার। এর ১৪ বছর পর (১৪০২ বঙ্গাব্দ) বৃষ্টিপাত সংকট মাত্রা কিছুটা অতিক্রম করে। এর পর থেকে চৈতালি ঢলের ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ কমে গিয়ে সাত বছরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। যেমন—১৪০৯ ও ১৪১৬ বঙ্গাব্দে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৬৬ ও ২৬৫ মিলিমিটার। সাধারণ বছরের তুলনায় যথাক্রমে ২.৬৩ ও ৪.২০ গুণ বেশি (সাধারণ বছরে ওই সময়ে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমবেশি ৬৩ মিলিমিটার)। কিন্তু ১৪২৩-এ গিয়ে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬২৫ মিলিমিটার। সাধারণ বছরের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। ফলে সুনামগঞ্জসহ পুরো হাওর এলাকা ডুবে যায়। শুধু ধানই নষ্ট হয়ে যায় এমন নয়, মাছসহ পুরো হাওরের জীববৈচিত্র্য দুমড়েমুচড়ে যায়।
বৈশাখী ঢলের চেয়ে চৈতালি ঢল নিয়ে আমার বেশি ভয়। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের মৌসুমি ঢলের ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ কমে আসছে এবং প্রখরতা বাড়ছে। ব্রির গবেষণা মোতাবেক এ সময় এখন মাত্র সাত বছর। ভবিষ্যতে ‘প্রত্যাবর্তন-সময়’ আরো কমতে পারে। গত ১৪২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্রে এমন ঘটনা আমরা দেখেছি। এখন ১৪৩০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস। অর্থাৎ আগাম ঢল (যদি আসে) আসার প্রকৃষ্ট সময় দোরগোড়ায়।
এ ধরনের ‘প্রলয়’ বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই বলে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ক্ষতিটাকে (যদি এমন কিছু ঘটে যায়) সাময়িক ভেবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হবে। কারণ এভাবেই প্রকৃতি মাঝেমধ্যে ধুয়েমুছে সাফ করে নিজেকে পরিশুদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করে নেয়। ফলে পরের বছর অতিরিক্ত উৎপাদন দিয়ে আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন